হিন্দুধর্ম ও নৈতিক মূল্যবোধ

অষ্টম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - হিন্দুধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা - | NCTB BOOK

অষ্টম অধ্যায়

হিন্দুধর্ম ও নৈতিক মূল্যবোধ

ব্যক্তি, সমাজ বা জাতি ও বৈশ্বিক পর্যায়ে একজন ব্যক্তি বা জাতির আচরণ অন্য ব্যক্তি ও সমাজ বা জাতির প্রতি কেমন হবে, তা নির্ধারণের মাপকাঠিই হচ্ছে নৈতিক মূল্যবোধ। এই মূল্যবোধ কতিপয় গুণের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে, যেমন মানবতাবোধ, সৎসাহস, ন্যায়বিচার, সৎসঙ্গ, সংযম, অহিংসা প্রভৃতি আমরা জানি, নৈতিক মূল্যবোধের মাপকাঠিতে বিচার করা যায় কে বা কোন জাতি কতটা সভ্য। ব্যক্তি ও সামাজিক ক্ষেত্রে ধর্ম নৈতিক মূল্যবোধ গঠনে সহায়তা করে। আবার নৈতিক মূল্যবোধ থেকে বোঝা যায়, কে কতটা ধর্মীয় মহৎ আদর্শ লালন করে। সুতরাং ধর্মের সঙ্গে নৈতিক মূল্যবোধের একটা নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। হিন্দুধর্মের ক্ষেত্রেও একথা প্রযোজ্য

আমরা এ অধ্যায়ে নৈতিক মূল্যবোধের ধারণা এবং ন্যায়বিচার, সৎসঙ্গ, সংযম ও অহিংসা - এ মূল্যবোধগুলো হিন্দুধর্মের আলোকে ব্যাখ্যা করব। ব্যাখ্যা করব পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে এ-সকল মূল্যবোধ গঠনের উপায় ।

অহিংসা এবং সহিংসতা সম্পর্কে আলোচনা করব এবং এইডস রোগের কারণ, এর প্রভাব ও এর প্রতিরোধের উপায় ব্যাখ্যা করব

এ অধ্যায় শেষে আমরা -

• নৈতিক মূল্যবোধের ধারণা ব্যাখ্যা করতে পারব

• হিন্দুধর্মের আলোকে ন্যায়বিচার, সৎসঙ্গ, সংযম ও অহিংসা- এ নৈতিক মূল্যবোধগুলো ব্যাখ্যা করতে পারব

• পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে ন্যায়বিচার, সৎসঙ্গ, সংযম ও অহিংসা নৈতিক মূল্যবোধগুলো গঠনের উপায় ব্যাখ্যা করতে পারব -

• এইচআইভি/এইডসের কারণ, প্রভাব ও এর প্রতিরোধে করণীয় এবং এইডস রোগে আক্রান্ত

রোগীর সঙ্গে কীরূপ আচরণ করা উচিত, তা হিন্দুধর্মের আলোকে ব্যাখ্যা করতে পারব

• ব্যক্তি ও সামাজিক জীবনে আলোচিত নৈতিক মূল্যবোধগুলোর প্রতিফলন ঘটাতে উদ্বুদ্ধ হব।

 

 

 

হিন্দুধর্ম ও নৈতিক মূল্যবোধ

পাঠ ১ নৈতিক মূল্যবোধের ধারণা

আমরা জানি, 'নীতি' কথাটির অর্থ হচ্ছে কোনটা ভালো কাজ আর কোনটা মন্দ কাজ তা উপলব্ধি করে ভালো কাজ করায় উদ্বুদ্ধ হওয়া এবং ভালো কাজে আত্মনিয়োগ করার প্রবণতা নীতির সঙ্গে জড়িত যে বিষয়, তাকে বলা হয় 'নৈতিকতা'। নৈতিক শিক্ষার অর্থ নীতি-সম্পর্কিত শিক্ষা ।

সত্য কথা বলা উচিত। তাই আমরা সবাই সর্বদা সত্য কথা বলব। গুরুজনদের ভক্তি করা কর্তব্য। তাই সবাই গুরুজনদের ভক্তি করব, তাঁদের সেবা করব। ঈশ্বরজ্ঞানে জীবের সেবা করব। কারণ জীবের মধ্যে আত্মারূপে ঈশ্বর বিরাজ করেন। এভাবে নৈতিক শিক্ষা থেকে জীবন-য -যাপনের ক্ষেত্রে আমাদের যে নৈতিকতাবোধ জাগ্রত হয়, তার নাম মূল্যবোধ ।

সকল মানুষেরই এ মূল্যবোধ থাকা প্রয়োজন। যদি কোনো ব্যক্তির মধ্যে বা সমাজে এর ঘাটতি দেখা দেয়, তাহলে আমরা বলি, মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটেছে। এ মূল্যবোধের প্রকাশ নানাভাবে ঘটতে পারে। যেমন- রুচি বা সৌন্দর্য সম্পর্কে মূল্যবোধ, জগৎ ও জীবন সম্পর্কে মূল্যবোধ ইত্যাদি ব্যক্তি, সমাজ বা জাতি এবং আন্তর্জাতিক- এ তিন পর্যায়েই নির্দিষ্ট মূল্যবোধ দ্বারা আমরা পরিচালিত হই । মূল্যবোধকে যখন নীতির সঙ্গে সম্পর্কিত করে দেখা হয়, তখন তাকে বলা হয় নৈতিক মূল্যবোধ । 'মূল্য' কথাটার দ্বারা মান বা পরিমাণ বোঝায়। মূল্যবোধ হচ্ছে জগৎ ও জীবন সম্পর্কে বিভিন্ন প্রকার বোধের একটা অংশমাত্র। সুতরাং এদিক থেকে নৈতিক মূল্যবোধ" মূল্যবোধের একটা মানকে নির্দেশ করে। যেমন- কোনো মানুষকে আমরা কেমন দৃষ্টিতে দেখব? নৈতিক মূল্যবোধ বলে নিজের সমান জ্ঞান করতে হবে। কিন্তু আমরা অনেক সময় পেশা, বিত্ত, পদমর্যাদা প্রভৃতি বিবেচনা করে কারো সঙ্গে ব্যবহারের মান নির্ধারণ করি। এতে নৈতিক মূল্যবোধের প্রতিফলন ঘটে না। যখন মানুষকে প্রকৃত মর্যাদা ও সম্মান দিতে বিত্ত, পেশা, পদমর্যাদা, ধর্মমত বিবেচনায় না নিয়ে সাম্যের দৃষ্টিতে দেখি, তখন তার মধ্যে ঘটে নৈতিক মূল্যবোধের প্রকৃত প্রকাশ ।

ধর্মের সঙ্গে নৈতিক মূল্যবোধের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। ধর্মসম্মত জীবন-যাপনের মধ্যে নৈতিক মূল্যবোধের প্রকাশ ঘটে। আবার নৈতিক মূল্যবোধগুলো ধর্মের অঙ্গ হিসেবে বিবেচিত হয়।

হিন্দুধর্ম নৈতিক মূল্যবোধের একটি উচ্চমান প্রত্যাশা করে। যিনি ধার্মিক, তাঁর আচরণের মধ্যে নৈতিক মূল্যবোধের প্রকাশ ঘটতেই হবে। কারণ নৈতিক মূল্যবোধগুলো ধর্মের অঙ্গ। এখানে আমরা হিন্দুধর্মের আলোকে ন্যায়বিচার, সৎসঙ্গ, সংযম, অহিংসা- এ মূল্যবোধগুলো সম্পর্কে জানব নতুন শব্দ: উদ্বুদ্ধ, বিত্ত, প্রতিপালন ।

 

 

হিন্দুধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা

পাঠ ২ ন্যায়বিচার

একসঙ্গে বসবাস করতে গিয়ে মানুষ যে প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে, তার নাম সমাজ। সমাজে সকলকে মিলেমিশে থাকতে হয়। কিন্তু নানা কারণে সমাজের সদস্যদের মধ্যে মতের অমিল দেখা দেয়। মতের অমিল মনের অমিলে পরিণত হয়ে ঝগড়া পর্যন্ত গড়ায়। তখন দুপক্ষের মধ্যে কে সঠিক এবং কে সঠিক নয়, তা নির্ণয় করতে হয়। আবার দুপক্ষের মধ্যে কাউকে অভিযুক্ত করলেই তাকে দণ্ড দেয়া যায় না। আসলেই সে অপরাধী কিনা তা নির্ধারণ করতে হয়। কোনো বিষয়ে কে সঠিক এবং কে ভ্রান্ত, অভিযুক্ত ব্যক্তি অপরাধী না নিরপরাধ এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের যে পদ্ধতি, তার নাম বিচার।

বিচারের সময় বিচারককে অবশ্যই নিরপেক্ষ থাকতে হয়। তাঁকে নির্ভুলভাবে বিচার করতে হয় কে সঠিক আর কে সঠিক নয়, কিংবা অভিযুক্ত ব্যক্তি অপরাধী না নিরপরাধ। কোনো পক্ষের প্রতি পক্ষপাতিত্ব না দেখিয়ে নীতি এবং ধর্ম বা আইনের আলোকে বিচার করার নাম ন্যায়বিচার ।

ন্যায়বিচার সমাজকে সুপথে পরিচালিত করার ক্ষেত্রে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে বিচারক যখন বিচার করেন, তখন কে পুত্র, কে বন্ধু, কে আত্মীয় তা দেখেন না। তাঁকে ন্যায়-নীতি, ধর্ম বা আইন এবং যুক্তির দ্বারা পরিচালিত হতে হয়। সেখানে শ্রদ্ধা, স্নেহ, ভালোবাসা প্রভৃতি আবেগের কোনো স্থান নেই । অভিযুক্ত ব্যক্তির জন্য কষ্ট পেলেও বিচারককে ন্যায়বিচার করতে হয়। এ বিষয়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন:

দণ্ডিতের সাথে দণ্ডদাতা কাঁদে যবে

সর্বশ্রেষ্ঠ সে বিচার।

আমরা বিষ্ণুভক্ত প্রহ্লাদের কথা জানি। তিনি দৈত্যকুলে জন্ম নিয়েও বিষ্ণুভক্ত ছিলেন। ন্যায়বিচারের জন্যও তিনি প্রসিদ্ধ হয়ে আছেন। এখন মহাভারত থেকে তাঁর ন্যায়বিচারের একটি উপাখ্যান জানব।

পাঠ ৩ : প্রহ্লাদের ন্যায়বিচার

বিষ্ণুভক্ত প্রহ্লাদ রাজত্ব করছেন। তাঁর সুশাসনে প্রজারা সুখেই আছে। তাঁর ছেলে বিরোচন বিরোচন রাজপুত্র বলেই হোক আর নিজের চরিত্রের জন্যই হোক, কিছুটা উদ্ধত আর অহংকারী তখন রাজধানীতে সুধন্বা নামে এক তরুণ ব্রাহ্মণ ছিলেন। তাঁর সঙ্গে রাজপুত্র বিরোচনের সম্পর্ক ভালো হিন্দুধর্ম ও নৈতিক মূল্যবোধ

ছিল না। একবার দুজনের মধ্যে কে জ্ঞানে ও গুণে অগ্রগণ্য তা নিয়ে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। তখন বিরোচন

বলেন, 'চল, আমরা বিশ্বান ব্যক্তিদের ওপর এ বিষয়ে বিচারের ভার অর্পণ করি তখন সুধন্বা বললেন, 'রাজা হলেন শাসক। সুতরাং রাজার কাছেই বিচার প্রার্থনা করা উচিত। চল, আমরা তোমার পিতা মহারাজ প্রতাদের কাছে যাই। আশাকরি তিনি ন্যায়বিচার করবেন ।

দুজনে মহারাজ প্রত্যুদের কাছে গিয়ে বিচার প্রার্থনা করলেন। মহারাজ প্রহ্লাদ সব শুনে বললেন, 'রাজপুত্র বিরোচন শক্তিমান ও বুদ্ধিমান, কিন্তু তার উচ্চতা ও অহংকার তার চরিত্রকে কিছুটা মলিন করেছে- যেমন চাঁদের রয়েছে কলঙ্ক?

বিরোচন। পিতা!

প্রহ্লাদ হ্যাঁ পুত্র। বাধা দিওনা, আমাকে বলতে লাও।

প্রহ্লাদ বলতে লাগলেন। ব্রাহ্মণকুমার সুধন্বা ধর্মপরায়ণ, সত্যবাদী এবং ধৈর্য ও সংযমের বলে

হিন্দুধর্ম ও নৈতিক শিক্ষा

বলীয়ান। অহিংসা তার চরিত্রকে আরও উজ্জ্বল করেছে। সুতরাং তোমাদের দুজনের মধ্যে সুধম্বাই জানে ও গুণে অগ্রগণ্য পুত্রের প্রতি পক্ষপাতিত্ব না দেখিয়ে নিরপেক্ষভাবে প্রহ্লাদের এ বিচার ন্যায়বিচারের এক উজ্জ্বল

দৃষ্টান্ত হয়ে আছে একক কাজ। প্রহ্লাদের ন্যায়বিচারের শিক্ষা তুমি কীভাবে জীবনাচরণে প্রয়োগ করবে?

পাঠ ৪ ও ৫ সদস

সৎসঙ্গ হচ্ছে সৎলোকের সান্নিধ্য। সৎ লোকের সঙ্গে চলা-ফেরা, ওঠা-বসা কিংবা জীবন-যাপন। সৎসঙ্গ অত্যন্ত মধুর। সৎলোকের সঙ্গে থাকলে নিশ্চিন্ত থাকা যায়। কারণ সৎলোক কারো ক্ষতি তো করেনই না, বরং পারলে উপকার করেন। তাই তো প্রবচন আছে, 'সৎসঙ্গে স্বর্গবাস, অসৎসঙ্গে সর্বনাশ'।

শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব বহুবার সৎসঙ্গের কথা ভক্তদের বলেছেন। তিনি বলেছেন যে, সৎসঙ্গ মনকে পবিত্র করে, চরিত্রকে উন্নত করে এবং ভক্তিভাব জাগ্রত করে। আমরা শুনেছি পরশপাথর লোহাকে স্বর্ণে পরিণত করে। তেমনি সৎসঙ্গ দুর্বৃত্তকেও সৎ ও মহৎ করে তোলে। এ সম্পর্কে একটি কাহিনি বলছি:

সাধু ও শ্ৰীধৰ

ছায়াসুনিবিড় সুন্দর একটি গ্রাম। সেখানে বাস করত একটি কিশোর। নাম তার শ্রীধর। ভীষণ দুষ্ট ছিল সে। অল্পতেই রেগে যেত। ঝগড়া লাগিয়ে মারামারি করত। এমনকি চুরি করতেও তার কোনো কুণ্ঠা ছিল না।

শ্রীধর একদিন ঘুরতে ঘুরতে এল বদরিকা আশ্রমে। বিখ্যাত আশ্রম। কত মন্দির, কত ধর্মশালা, কত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ।

সেখানকার এক মন্দিরে গেল সে। দেখন, মন্দিরের বিগ্রহের গলায় ঝুলছে মুক্তার মালা। রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করল সে। তারপর গভীর রাতে সুকৌশলে চুরি করল দেববিগ্রহের গলার সেই মুক্তার মালা। চুরি করে সেখান থেকে পালাল সে। সুন্দর মালাটি গলায় পরে সে পথ চলতে লাগল। ঘুরতে ঘুরতে সে এল এক সাধুর আশ্রমে।

হিন্দুধর্ম ও নৈতিক মূল্যবোধ

সাধু তাঁর সাধনার পাশাপাশি অন্যের সেবা-শুশূষা করেন। বলেন, জীবকে সেবা করলে ঈশ্বরকে সেবা

করা হয়। সাধু শ্রীধরকে বললেন, 'আমার একটা উপকার করতে পারবে, বাবা?'

শ্রীধর: 'কী করতে হবে বলুন।

সাধু তখন তাঁর ঝোলা থেকে একটি মুক্তা বের করে বললেন, 'এ মুক্তাটি একজনের মালা থেকে খসে পড়েছে। মালার মালিক বদরিকা আশ্রম থেকে এসেছেন। তিনি চলছেন তাঁর দেশে। মুক্তাটি আমি তোমায় দিচ্ছি। পথ চলতে যদি দেখা হয়, তাহলে ওটা তাঁকে দিয়ে দিও।'

শ্রীধর মুক্তাটি হাতে নিল। তারপর নিজের মালায় হাত দিয়ে দেখল, মুক্তাটি তার গলার মালা থেকেই খসে পড়েছে। কখন কীভাবে পড়েছে, তা সে নিজেই জানে না।

সাধুকে প্রশ্ন করল শ্রীধর: 'আপনি কেমন করে জানলেন যে আমার গলার মালা থেকেই মুক্তা খসে পড়েছে? কিন্তু মালাটি আমার নয়, আমি এটা বদরিকা আশ্রমের এক দেববিগ্রহের গলা থেকে চুরি

করেছি। এখন কী করব আমি?

একথা বলেই সে কাঁদতে লাগল ।

সাধু বুঝলেন, অসৎ হৃদয়ে সততার উদয় হয়েছে। তিনি শ্রীধরকে বললেন, 'বাবা শ্রীধর, একবার

পাপ করলে যে চিরকাল করতে হবে, তা নয়। এস, পুণ্যের পথে এস। দেবতার মালা তুমি দেবতাকে ফিরিয়ে দিয়ে এস। তাহলে তিনিই তোমাকে ক্ষমা করবেন।

সাধুর কথামতো শ্রীধর বদরিকা আশ্রমে গেল। কাউকে না জানিয়ে দেববিগ্রহের গলায় সেই মুক্তার মালাটি পরিয়ে দিল। তারপর বাড়ি না গিয়ে ফিরে গেল সেই সাধুর আশ্রমে।

শ্রীধর সাধুর সঙ্গে থাকে। সাধু প্রতিদিন ভোরে স্নান করেন। শ্রীধরও প্রতিদিন ভোরে উঠে স্নান করা শুরু করল। সে লেগে পড়ল আশ্রমের নানা কাজে ।

একদিন নদীতে একটি বিড়ালকে হাবুডুবু খেতে দেখে সে ঝাঁপ দিয়ে পড়ল। তুলে আনল বিড়ালটিকে । আরেকদিন সংক্রামক ব্যাধিতে মৃত এক ভিখারির শব কাঁধে করে শ্মশানে নিয়ে গেল সে। এভাবে আর্তের সেবায় ব্রতী হলো শ্রীধর।

হিন্দুধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা

একদিন সে সাধুর অনুমতি নিয়ে বাড়ি গেল। তাকে দেখে কেউ চিনতে পারল না। পারবে কী করে? সে তো আর আগের শ্রীধর নেই। সে এখন তরুণ সাধক। তবে তার মা তাকে চিনলেন । তিনি বিস্ময়ের সঙ্গে বললেন, 'শ্রীধর, তুই!'

শ্রীধর: 'হ্যাঁ মা, আমি। আমি তোমার শ্রীধর।

দুর্বৃত্ত শ্রীধর নয়, চোর শ্রীধর নয়। সে এখন সৎ ও সেবাব্রতী শ্রীধর।

সৎসঙ্গ এভাবে দুর্বৃত্তকে সৎ ও সেবাব্রতী এক মহান মানুষে পরিণত করতে পারে । সৎসঙ্গের এমনই মহিমা।

দলীয় কাজ: শ্রীধরের শিক্ষা ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে কী প্রভাব ফেলতে পারে তা নিজেদের মধ্যে আলোচনা কর।

নতুন শব্দ: কুণ্ঠা, ধর্মশালা, বিগ্রহ, শব, ব্রতী, দুর্বৃত্ত, সেবাব্রতী।

পাঠ ৬ ও ৭ সংযম

'সংযম' কথাটির অর্থ হলো নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা। শাস্ত্রে হিন্দুধর্মের যে দশটি লক্ষণের কথা বলা হয়েছে, 'দম' ও 'ইন্দ্রিয়নিগ্রহ' সেগুলোর অন্তর্গত। 'দম' মানে দমন করা। 'ইন্দ্রিয়নিগ্রহ' মানে ইন্দ্রিয়কে নিয়ন্ত্রণ করা। ইন্দ্রিয়ের দাবি অনুসারে না চলে নিজের ইচ্ছেমতো চলাকেই বলে “ইন্দ্ৰিয়নিগ্রহ'।

একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি আরও স্পষ্ট হবে। ধরা যাক, বাড়িতে বিয়ের অনুষ্ঠান চলছে। একটি ঘরে প্রচুর দই-মিষ্টি এনে রাখা হয়েছে । আমি ঐ ঘরে ঢুকলাম ঘরে আর কেউ নেই আমার লোভ হলো, ওখান থেকে একটা মিষ্টি তুলে খাই। কেউ তো আর দেখছে না। পরক্ষণেই চিন্তা হলো, মানুষ না-হোক ঈশ্বর তো দেখছেন। তাছাড়া চুরি করা অনৈতিক কাজ। তাই আমি লোভকে দমন করলাম। এর মধ্য দিয়ে আমার জিহ্বা নামক ইন্দ্রিয়কে নিগ্রহ বা নিয়ন্ত্রণ করা হলো। দম ও ইন্দ্রিয়নিগ্রহকে একসঙ্গে সংযম বলা হয়।

সংযম তপস্যার অংশ। তপস্যা হচ্ছে লক্ষ্য অর্জনের জন্য সযত্ন প্রচেষ্টা। যোগশাস্ত্রে বলা হয়েছে, ধর্মের চারটি ভিত্তি – তপস্যা, শৌচ, দয়া ও সত্য। তপস্যাই মূল ধর্ম। অপর তিনটি তপস্যার অংশ বলে বিবেচিত। তপস্যার আবার প্রকারভেদ আছে, যেমন শারীরিক তপস্যা, বাচিক - তপস্যা, মানসিক তপস্যা ইত্যাদি। শীত, গ্রীষ্ম, ক্ষুধা, তৃষ্ণা ইত্যাদি সহ্য করা, দেবতাদের পূজা হিন্দুধর্ম ও নৈতিক মূল্যবোধ

করা, গুরুজনদের শ্রদ্ধা করা, সরলতা, অহিংসা প্রভৃতি শারীরিক তপস্যা। সত্য, প্রিয় ও হিতকর বাক্যের প্রয়োগ এবং শাস্ত্রপাঠকে বলা হয় বাচিক তপস্যা। আর চিত্তের প্রসন্নতা, অনিষ্ঠুরতা, বাকসংযম ও আত্মসংযম (নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা), ছল-চাতুরী না-করা ইত্যাদি হচ্ছে মানসিক তপস্যা । সুতরাং দেখা যাচ্ছে, সংযম তপস্যার অংশ এবং ধর্মেরও অঙ্গ।

সংযম ছাড়া জীবন হালহীন নৌকা বা বল্গাহীন ঘোড়ার মতো। কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না। ফলে জীবনে আসে উচ্ছৃঙ্খলতা। সংযম আমাদের চরিত্রকে শৃঙ্খলামণ্ডিত ও মহৎ করে। সুতরাং সংযম সাধনা সিদ্ধিলাভের অন্যতম প্রধান উপায় ।

সংযম ব্রহ্মচর্যের অংশ । সংযমের মধ্য দিয়ে গুরুগৃহে শিক্ষাজীবন অতিবাহিত করার সময়কালকে শাস্ত্রে ব্রহ্মচর্য বলা হয়েছে । সুতরাং সংযম হচ্ছে ছাত্রজীবনের একটি অঙ্গ

সংযম না থাকলে ব্যক্তিগত ও সামাজিক যে-কোনো কাজ পণ্ড হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই তো বলা হয়, সংযম হারিয়ে রেগে গেলেন তো হেরে গেলেন । সংযমকে সারা জীবনের সঙ্গী করতে হবে। জীবনের সকল ক্ষেত্রে সংযম বজায় রাখতে হবে। সংযম

জীবনের সহায়ক। পরমতসহিষ্ণু হতে হলেও সংযমের অভ্যাস করতে হবে। সংযম ও পরমতসহিষ্ণুতা

ব্যক্তি জীবন ও সমাজ জীবন পরিচালনার ক্ষেত্রে অপরিহার্য।

একক কাজ জীবনে সংযমের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে পাঁচটি বাক্য লেখ।

নতুন শব্দ: দম, ইন্দ্ৰিয়নিগ্রহ, তপস্যা, শৌচ, বাচিক, হিতকর, প্রসন্নতা, বাকসংযম, ছল-চাতুরী, হালহীন, বল্গাহীন, সিদ্ধিলাভ

পাঠ ৮: অহিংসা

জীবকে পীড়ন ও হত্যা না-করাকে বলা হয় অহিংসা। যোগশাস্ত্রে যম (সংযম), নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম, প্রত্যাহার, ধ্যান, ধারণা ও সমাধি নামে আটটি অঙ্গের কথা বলা হয়েছে। যম বা সংযম অহিংসার ভিত্তি।

সহিংসতা অহিংসার বিপরীত। জীবকে পীড়ন বা হত্যা করার প্রবৃত্তিকে বলে সহিংসতা।

হিন্দুধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা

আমরা বিত্ত, খ্যাতি, প্রতিপত্তি, যশ ইত্যাদি পেতে চাই। আর এগুলো পাওয়ার পথে যারা বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তাদের প্রতি সহিংস আচরণ করি। এ আচরণ অনৈতিক ।

সহিংসতা সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে এবং মানুষকে কষ্ট দেয়। অনেক সময় সহিংসতা প্রাণ হরণেরও কারণ হয়। সুতরাং সহিংসতা অধর্ম।

মনুসংহিতায় বলা হয়েছে, যিনি নিষ্ঠুর আচরণ করেন না, কাউকে হিংসা করেন না, তিনি স্বর্গলোক জয় করতে পারেন (৪/২৪৬)। মনুসংহিতা থেকে অহিংসা সম্পর্কে আরও জানতে পারি যে, যিনি অহিংস, তিনি ধর্মকৃত্যসহ সকল সৎকাজে সাফল্য লাভ করেন (৫/৪৫)।

শুধু মনুসংহিতায়ই নয়, হিন্দুধর্মের বিভিন্ন গ্রন্থে অহিংসা সম্পর্কে বিস্তর আলোচনা করা হয়েছে অহিংসা যম (সংযম) নামক যোগের অংশ হিসেবে সাধনা বা তপস্যার সহায়ক, ইহলোকের অবলম্বন এবং মোক্ষলাভের অন্যতম প্রধান উপায়। ভাই তো বলা হয় 'অহিংসা পরম ধর্ম' মহাভারতে যুধিষ্ঠিরকে উপদেশ দিতে গিয়ে ভীষ্ম বলেছেন, সকল জীবে অহিংসা পরম ধর্ম বলে জানবে ।

হিংসার পরিণাম শুভ হয় না। কৌরবেরা পাণ্ডবদের হিংসা করতেন। তাই তাঁদের পরিণাম শুভ হয়নি।

তবে অহিংসা বলতে কিন্তু কাপুরুষতা বা ভীরুতাকে বোঝায় না। নির্বিচার ক্ষমাও বোঝায় না। ন্যায়বিচার করে অপরাধীর শাস্তিদান হিংসা বলে গণ্য হবে না।

নিজের স্বার্থে পরপীড়ন, পরের ক্ষতি করার চেষ্টা বা কাউকে হত্যা করাকেই সহিংসতা বলা হয়েছে। সুতরাং পরপীড়ন না-করাই অহিংসা। অহিংসা ব্যক্তিকে মহান করে, সমাজে শান্তি আনে। অহিংসা ধর্মের অঙ্গ এবং একটি অনুসরণীয় নৈতিক মূল্যবোধ ।

নতুন শব্দ: যোগশাস্ত্র, প্রবৃত্তি, ইহলোক, মোক্ষলাভ, কৌরব পাণ্ডব

Content added || updated By
Promotion